গাজার প্রথম নারী মৎস্যজীবী ম্যাডলিন কুলাবের নামে নামকরণ করা হয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলিন’। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীর জন্য এই নাম শুধু একটি প্রতীকই নয়, এক অনন্য প্রতিবাদের ভাষাও।
তিন বছর আগে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার চোখে পড়েন এই সাহসী নারী। তখন তার দুই সন্তান, তৃতীয় জন আসার অপেক্ষায়। স্বামী খাদির বাকরের সঙ্গে গাজা সিটিতে শান্তিপূর্ণ জীবন কাটছিল। দুজনেই ছিলেন পেশাদার মৎস্যজীবী।
ইসরায়েলি নৌ-অবরোধের মধ্যেও প্রতিদিন সাহস করে সাগরে নামতেন ম্যাডলিন। যতদূর যাওয়া সম্ভব, ততদূর গিয়েই তুলে আনতেন পরিবারের জন্য জীবনের রসদ—মাছ। সেই মাছ বেচেই চলত সংসার। কিন্তু যুদ্ধ সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে এক বিমান হামলায় নিহত হন ম্যাডলিনের বাবা। তারপর শুরু হয় এক উদ্বাস্তু জীবনের করুণ অধ্যায়। গর্ভবতী অবস্থায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় খান ইউনিস, রাফাহ, দেইর আল-বালাহ ও নুসাইরাতে।
শেষমেশ তারা ফিরে এসেছেন গাজা সিটিতে, নিজ বাড়িতে—যেটি আজ ধ্বংসস্তূপ। সেই ভাঙা ঘরের এক কোণে জীর্ণ সোফায় বসে আছেন ম্যাডলিন। কোলে এক বছরের মেয়ে ওয়াসিলা, পাশে পাঁচ বছরের সাফিনাজ এবং তিন বছরের জামাল—যে সন্তান তখন ছিল তার গর্ভে, যখন প্রথমবার আল জাজিরা তার সাক্ষাৎ নেয়।
‘জাহাজটি আমার নামে নামকরণ করা হয়েছে জেনে আমি অভিভূত। এক গভীর দায়িত্ব আর গর্ব অনুভব করছি,’ বলেন ম্যাডলিন, হালকা হাসি দিয়ে।
জাহাজের ১২ সদস্যের কর্মী দলে আছেন সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য রিমা হাসান। তাদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ম্যাডলিন বলেন, ‘তারা নিজেদের জীবন, আরাম সব কিছু ত্যাগ করে গাজার জন্য এসেছেন। এটি মানবতার সবচেয়ে সাহসী রূপ।’
মাত্র ১৫ বছর বয়সে মাছ ধরার জগতে পা রাখেন ম্যাডলিন। বাবার নৌকায় চেপে যেতেন সাগরে। গাজার সব মৎস্যজীবী তাকে চিনতেন। আন্তর্জাতিক সংহতির কর্মীদের মাঝেও ছিলেন পরিচিত মুখ।
তিনি ছিলেন শুধু একজন মৎস্যজীবীই নন, বরং একজন দক্ষ রন্ধনশিল্পীও। মৌসুমি মাছ, বিশেষ করে গাজার জনপ্রিয় সার্ডিন দিয়ে এমন সব পদ রান্না করতেন যে, তার কাছ থেকে খাবার নিতে লোকের লাইন পড়ত।
কিন্তু আজ, যুদ্ধ সব কেড়ে নিয়েছে। মাছ ধরার নৌকা নেই, সরঞ্জাম নেই, এমনকি এক বেলার খাবারও নিশ্চিত নয়। কাঁদতে কাঁদতে ম্যাডলিন বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা শুধু রুটি-রুজি হারাইনি, হারিয়েছি আমাদের পরিচয়, আমাদের আত্মা। মাছ তো দূরের কথা, আজ একমুঠো খাবারও স্বপ্ন।’
গাজার আকাশে যুদ্ধবিমান, আর ম্যাডলিনের হৃদয়ে একসময়কার শান্ত সমুদ্রের ঢেউ—এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজ তার নামেই ভেসে বেড়াচ্ছে এক মানবিক প্রতিরোধের জাহাজ।